– মমতাজ উদ্দিন আহমদ

 

নান্দনিক মাতামুহুরী, মায়ের সাথে নামের সংযুক্তি! এ নদীর কোলে আমার বসবাস। জন্ম এ নদীর পাড়ে। শিশু এবং তারুণ্যের উন্মাদনা কেটেছে এ নদীর বুকেই, কেটেছি সাঁতার তারই ¯্রােতে!

মাতামুহুরীকে ঘিরে রয়েছে শত স্মৃতি, আনন্দ ও বেদনা। বিষাদ কিংবা বিলাপেও রয়েছে এই নদী!

প্রেয়সীর আঁচলের মতো এ নদী দু’তীরজুড়ে বিছিয়ে দিয়েছে সবুজাভ অরণ্য। এখানে পাহাড়ি লোকাচারের পাশাপাশি রয়েছে শহুরে সংস্কৃতির ঝলকানিও!

এ নদী যেন জীবনেরসত্তা, বিত্ত-বৈভব আর সুখের প্রবাহ; একইসাথে লাস্যময়ী-হাস্যময়ী-রূপময়ী-রহস্যময়ী! তার চলনের গতি যেন কোন সুরূপা-অপরূপার এঁকেবেঁকে হেঁটে চলা!

খর¯্রােতা মাতামুহুরী প্রাচীনকাল থেকে এখনো অনেক পরিবারের জীবন-জীবিকার পরম নিভর্রতা-নিশ্চয়তা। তাদের কাছে এ নদী যেন প্রাত্যহিক আনন্দ-বেদনা-বিসংবাদের মহাকালের মহাস্রোত!

সুদূর অতীত থেকে এ নদী প্রাকৃতিক পরিবেশের, ভূ-সম্পদের, অর্থ আর বাস্তুতান্ত্রিকতার প্রাণকেন্দ্র। তাই এ নদীর সাথে এসব মানুষের সম্পর্ক সতত, প্রণবন্ত ও অবিচ্ছেদ্য। অনন্তকালের অভিযাত্রায় এ নদী তাদের সুখ-দুঃখের পরম সাথী।

এ নদীর অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণও উল্লেখযোগ্য। নদীর বুকে কাঠ, বাঁশ এবং নৌপরিবহন এতদাঞ্চলের অর্থনীতির চাকায় এনেছে গতি।

খর¯্রােতা মাতামুহুরী বর্ষাকালে আবার দুঃখেরও কারণ। নানান সময়ে এ নদী সৃষ্টি করে শোকের আবহ। কারণ কত নিঃষ্পাপ জীবন কেড়ে নেয় এ নদীর ¯্রােত! ক’বছর ধরে ভাঙ্গছে নদীর তীর। বিলীন হচ্ছে জনপদ আর সহায়-সম্পদ। তবে বছরজুড়ে সুখের পরশে এ দুঃখ স্থায়ী নয়।

সবকিছু ছাড়িয়ে গিরিনন্দিনী মাতামুহুরীর দু’তীরে দেখা মিলে ছায়াঘেরা পাখি ডাকা সুউচ্চ পাহাড়ের নির্মল উদারতা ও গাঢ় সবুজের মাখামাখি।

নদীর বুকে যখন পর্যটকরা ভ্রমণ করেন তখন দু’তীরজুড়ে বিটপী কান্তরের শৈলসারির মুগ্ধতায় ভরে যায় মন। যার অন্তর্নিহিত সুষমা, সুশোভিত-সুরূপময় নান্দনিকতার প্রকাশ অসাধ্য। কেবল অন্তরের ধ্যানলোকেই বুঝা সম্ভব! সবুজ অরণ্যানীর নান্দনিকতার সাথে নদীর কুলকুল রব প্রকৃতিতে আনে বৈচিত্র্য।

ষড়ঋতুর বৈচিত্র্যতায় ¯্রােতস্বিনী মাতামুহুরীর প্রাকৃতিক পরিবেশে লক্ষ্য করা যায় পরিবর্তিত রূপ। যা নদীর পাড়ের মানুষের মন-মেজাজ-মননে, প্রাণে-স্পন্দনে, গান-গুঞ্জরণে সারাবছর বিচিত্র ভাব ও আবেশের সৃষ্টি করে।

দু’দশক আগে মাতামুহুরীর বাঁকে বাঁকে ছিল কাজল কালো জল। এ জলাধারগুলোকে স্থানীয়রা ‘কুম’ হিসেবে চিনতো। এখন আর সেই গভীরতা নেই। নদীর পাড়ের সুবিন্যস্ত সবুজাভ সজ্জা নেই। হেমন্তে কাশফুলের উদ্যামতাও দেখা যায় না।

পার্বত্য জনপদ আলীকদম ও লামায় সমাজ-সভ্যতা সৃষ্টির অন্যতম কারিগর এই শৈবলিনী মাতামুহুরী। পাশাপাশি সমতলের চকরিয়া উপজেলা আর লামা-আলীকদমের আঞ্চলিক সামাজিকতাকে করেছে সজীব-পুষ্ট ও হৃষ্ট।

শত-সহ¯্র বর্ষের ঐতিহ্যের ধারক-বাহক প্রবাহিণী মাতামুহুরী। নদীঘেঁষা জনপদে সুদূর প্রাচীনকালে গড়ে উঠেছিল সভ্যতা। এ নদীর অববাহিকা ঘিরে গড়ে উঠে জনবসতি। নদীর পানি সিঞ্চনে প্রতিবছর আবর্তিত হয় কৃষি অর্থনীতি। ফলে এ নদীর উদারতা পাহাড়ি জনপদ আলীকদম-লামা ও সমতলের চকরিয়া উপজেলাকে দিয়েছে নান্দনিক বৈভব। এ যেন মহান ¯্রষ্টার অতুলনীয় সৃষ্টি ও ঐশ্বর্য।

ষড়ঋতুর পালাবদলে মাতামুহুরীর অববাহিকায় আসে পরিবর্তন। বর্ষা-বাদলে নদীর বুকে আসে মায়াবতী আবেগ। তখন পানির ¯্রােতে ক্ষয় করে নদীর পাড় আর জনপদ। ক্ষতি হয় ক্ষেত-ফসলের।

হেমন্ত-শীত ও বসন্তে মাতামুহুরীর বুক থাকে তারুণ্যের মায়াময় চঞ্চলতায় ভরা। চলার ছন্দ থাকে নান্দনিকতায় পরিপূর্ণ। তবে গ্রীষ্মে এ নদীর বুকে জেগে উঠে অসংখ্য বালুর চর।

প্রকৃতিতে মাতামুহুরীর অবদান হয়তো অন্য দশটা নদীর মতোই। তবে এ নদীর মাধ্যমে এ জনপদের মানুষ প্রকৃতির সাথে মেলবন্ধন ঘটানোর সুযোগ পেয়েছে।

মাতামুহুরী পার্বত্য চট্টগ্রামের দ্বিতীয় বৃহত্তম নদী। বৃহত্তর চট্টগ্রাম বিভাগের মধ্যে অন্যতম। লামা এবং আলীকদম উপজেলার অসংখ্য জলনির্গম প্রণালী থেকে এ নদী পুষ্ট হয়েছে। উৎসমুখ থেকেই ছোট-বড় উপনদী-খাল-ঝিরি-ঝর্ণার পানি এসে যুক্ত হয়েছে মাতামুহুরীতে।

জনশ্রুতি মতে, মাতামুহুরী নদী একক কোন উৎস হতে সৃষ্টি নয়। মাতৃস্তন সদৃশ্য অসংখ্য পাহাড়ের গা বেয়ে পানি চুয়ে চুয়ে পড়ে বিভিন্ন শাখা খাল বা ঝিরির পানিতেই মাতামুহুরীর সৃষ্টি। মুহুরী শব্দের অর্থ অসংখ্য ছিদ্র দিয়ে পানি পড়ার ঝাঁঝর। ইংরেজিতে যাকে বলে শাওয়ার (ঝযড়বিৎ)। এভাবে অনেকগুলো শাখা-প্রশাখার পানি শাওয়ার আকারে ঝরে এই নদীতে মিলিত হয় বলেই এ নদীর নাম মাতামুহুরী।

মার্মা ভাষায় মাতামুহুরী নদীর নাম- মোরেই খ্যোং বা মেরিখ্যাইং। মোরেই বা মেরি শব্দের অর্থ মাতামুহুরী আর খ্যোং বা খ্যাইং শব্দের অর্থ নদী।

তরঙ্গিনী মাতামুহুরীর উৎপত্তি আলীকদম উপজেলার বাংলাদেশ এবং মিয়ানমার সীমান্তের পাহাড়ি এলাকা থেকে। উৎপত্তিস্থলে নদীটি যেখানে গিয়ে তার নাম হারিয়েছে সরেজমিন সেখানে যাওয়ার অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার। স্থানটির নাম দোছরি-ফাত্তারা। দোছরি ও ফাত্তারা পৃথক দু’টি খাল বা উপনদী। এ দু’টি খালের সংযোগ স্থল থেকেই মাতামুহুরী নদীর শুরু! এ স্থানটি ইংরেজি ণ (ওয়াই) অক্ষরের মতো।

দোছারী-ফাত্তারার নীচের দিকে মাতামুহুরীর পাড়ঘেঁষে একটি উপত্যকায় রয়েছে একটি মুরুং পাড়া। যার নাম পাহাড়ভাঙ্গা। সুউচ্চ পাহাড় থেকে একসময় এ উপত্যকায় একটি ঢাল ভেঙ্গে পড়েছিল। পাহাড় ভাঙ্গা এলাকার বাসিন্দারা মুরুং উপজাতি। এ জনপদের একজন জনপ্রতিনিধির নাম কামপুক মুরুং মেম্বার। তাঁর মতে ‘দোছরি-ফাত্তারা’র পর আর মাতামুহুরী নেই! এখানেই মাতামুহুরীর শুরু। অনাদিকাল থেকেই তারা এ স্থানকে মাতামুহুরীর নদীর উৎপত্তিস্থল হিসেবে জানেন।

তবে ভিন্নমতও রয়েছে এ নিয়ে।

অনেকে মতে, দোছরি খাল যেখান থেকে সৃষ্টি হয়েছে সেটিই হবে মাতামুহুরীর উৎসমুখ! কারণ নদীর সংজ্ঞা অনুযায়ী সেটিই হওয়ার কথা। দোছরি খালটির উৎপত্তিস্থল ‘ওয়ালিতং’ পাহাড়। এ পাহাড়টি বাংলাদেশ-মায়ানমার সীমান্তবর্তী। তবে পাহাড়টি বাংলাদেশের অভ্যন্তরেই। সুতরাং বলা যায় ‘ওয়ালিতং’ পাহাড়ই কল্লোলিনী মাতামুহুরীর উৎসমুখের পাহাড়!

উৎসমুখ থেকে এঁকেবেঁকে আলীকদম উপজেলার পশ্চিমুখী ভূমিঢাল বেয়ে মাতামুহুরীর মোহনা মিশেছে বঙ্গোসাগরে। উৎপত্তিস্থল হিসেবে মাতামুহুরী একান্তভাবেই বাংলাদেশের নদী।

উৎসমুখ থেকে মোহনা পর্যন্ত মাতামুহুরীতে যুক্ত হয়েছে অসংখ্য উপনদী-খাল-ঝিরি-ঝর্ণা। এসব উপনদী-খাল-ঝিরির রয়েছে বাহারি নাম। মাতামুহুরীর অন্যতম একটি উপনদীর নাম তৈনখাল। এ খালের দু’তীরে রয়েছে সবুজের অবারিত সৌন্দর্য্য। তৈনখালের রয়েছে ছন্দময়-বর্ণময় ¯্রােত। আছে আনন্দ-বেদনার ঐতিহাসিক উপাখ্যান!

এছাড়াও শতাধিক খাল-ঝিরি প্রকৃতির আনন্দ-ষড়ঋতুর বৈচিত্র্য বুকে ধারণ করে উদাসী বেশে নিজেকে সমর্পন করেছে মাতামুহুরীর বুকে। সব ক’টি খালের প্রকৃতি এতটাই মুগ্ধ করার মতো যে, এরা যেন বৈচিত্র্যের পরশ গায়ে মেখে ছুটে চলা উদাসী পথিক!

এসব খাল এবং ঝিরির নামকে ঘিরে মাতামুহুরী উপত্যাকায় তৈরী হয়েছে জনপদের নাম, লোকালয় ও জীবনের সার্বজনীন প্রবাহ। যেমন: কুরুকপাতা ঝিরিকে ঘিরে আশির দশকে গোড়াপত্তন হয় কুরুকপাতা বাজার। ২০১৪ সালে সৃষ্টি হয় কুরুকপাতা ইউনিয়ন-এর। একইভাবে পোয়ামুহুরী খালকে ঘিরে নব্বইয়ের দশকে তৈরী হয়েছে পোয়ামুহুরী বাজার।

তৎকালীন বৃটিশ সরকার ১৮৮০ সালের ১৭ নভেম্বর মাতামুহুরী নদীর উপত্যকায় ১ লক্ষ প্রায় ৩ হাজার একর পাহাড়কে ‘মাতামুহুরী রিজার্ভ ফরেস্ট’ ঘোষণা করেন। এ রিজার্ভ ফরেস্ট মাতামুুহুরীর পানির অন্যতম যোগানদাতাও বটে।

প্রায় দু’যুগ আগেও ¯্রােতোবহা মাতামুহুরী সম্পদ-সম্ভারে ছিল পরিণত। তারুণ্যের উদ্বেলতা ছিল এ সমুদ্রকান্তার প্রবাহে। জল জীববৈচিত্রের বিপুল সম্ভারে ছিল পরিপূর্ণ। নদীর কিছুদূর পর পর ছিল তীব্র ¯্রােত। যাকে স্থানীয়রা ‘দরদরি’ হিসেবে চিহ্নিত করতো। কিন্তু বর্তমানে নদীটির স্বাভাবিক অবস্থা আর নেই। দীর্ঘ দু’যুগের বেশী সময় ধরে নদীর তীরে তামাক চাষ ও বৃক্ষ নিধনে পরিবেশ হয়েছে বিপর্যস্ত। প্রতিবছর পাহাড়ি জুমিয়াদের জুমচাষ নদী তরীবর্তী সবুজাভ পাহাড়গুলো হয়ে যায় শ্মশানের ছাইয়ের ধুসরতা।

একসময়ের পূর্ণযৌবনা মাতামুহুরী এখন কিছুটা সংকুচিত। নদীতে নাব্যতা সংকট শুরু হয় গ্রীষ্মমৌসুমে। আলীকদম সদর থেকে উজানে অন্তত ৮০-৯০ কিলোমিটার নদী অববাহিকা-উপত্যকাজুড়ে প্রতিবছর জুমচাষ হয়।

নানান কারণে এ নদীর বুকে এখন পলি জমছে। এভাবে চলতে থাকলে নদীটি সম্পদ থেকে সংকটে রূপান্তরিত হবে! পাহাড়ের সুখ-দুঃখ বয়ে বঙ্গোপসাগরের বুকে নিয়ে যায় সমুদ্রদয়িতা মাতামুহুরী। মাটিক্ষয় রোধ করা না গেলে দৈহিকভাবে অচিরেই শীর্ষকায়ায় সংকটাপন্ন হতে বাধ্য এ নদী।

নদীর উজানে ও পাড়জুড়ে সড়ক নির্মাণে কাটা হচ্ছে পাহাড়। কাটা পাহাড়ের মাটি গিয়ে পড়ছে ঝিরি, খাল ও নদীতে। নদীর তীরে ফসল আবাদে দেয়া হয় বিষ ও কীটনাশক। যা নদীটির প্রাকৃতিক পরিবেশকে নষ্ট করেছে। ফলে পানি হয়ে যাচ্ছে দূষিত।

অব্যাহত মাটির ক্ষয়, জুমচাষ, পাহাড়-কাটা, তামাক চাষ, সার কীটনাশকের অযাচিত ব্যবহারের প্রবাহিনী মাতামুহুরীর প্রকৃতি-পরিবেশকে নাজুক করছে দিন দিন। এ নদীকে সুরক্ষিত না রাখলে অচিরেই বিপন্নতার বেদনাভার সইতে হবে আগামী প্রজন্মকে।

গিরিনন্দীনি আলীকদমকে সবুজাভ প্রকৃতির অনুপম অনুভবে উপলব্ধি করতে হলে মাতামুহুরীর অবদানকে কোনভাবে অস্বীকার করা যাবে না। তাই আসুন সবাই সচেতন হই। আগামী প্রজন্মকে রক্ষা করতে সদা প্রস্তুত থাকি। নান্দনিক মাতামুহুরীকে মায়ের মতোই ভালোবাসি।

ক্যাপশান: মাতামুহুরী নদীর বিভিন্ন ছবি।